Friday, April 5, 2019

সাদা আর কালো মরুভুমি 
লিখেছেন  ব্লগার জুন 
[ প্রথম পর্ব ]
সাদা মরুভুমিতে এক অপুর্ব সৃস্টি চুনা পাথরের মাশরুম

আচ্ছা মরুভুমি কি কখনো সুন্দর হয় বলুনতো !
এ প্রশ্নটা অনেকের মত আমারও মনে ছিল সবসময়।
যদিও মরুভুমি আমি আগেই দেখেছি ভারতের জয়সলমীরে, মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইতে, কই ভালো তো লাগেনি তাকে একটুকুও।
কি তার রুক্ষ শুস্ক প্রকৃতি, আগুনের হল্‌কার মত বাতাস নামের এক ভয়ংকরের স্পর্শ।এক নি:শ্বাসে শরীরের সমস্ত আদ্রতা যেন শুষে নিচ্ছে আমার। শরীরের চামড়া এমন কেন ! পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এটা কি আমি !
এমনই এক অনুভুতি হয়েছিল আমার।
লু হাওয়ার সাথে ধুলো উড়ে চোখমুখ ভরে যাচ্ছে, কিচ কিচ করছে সব কিছু।
প্রচন্ড গরম, ভালোলাগার কি থাকতে পারে এখানে ! কিন্ত পশ্চিম মিশরের হোয়াইট ডেজার্টে এসে আমি কেমন অভিভুত হয়ে গেলাম এও কি সত্যি।অপার্থিব সৌন্দর্যের এই রূপ কি কখনো মরুভুমির হয়ে থাকে! চমকে গিয়েছিলাম আমি তার পর যখন শুনলাম তাও আবার সাদা কালো !

মিশরে পৌছানোর পর ট্যুর অপারেটর যখন বার বার বাহারিয়া ডেজার্ট সাফারীর কথা বলছিল তখন আমার পুরোনো অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে আমি কিন্ত কিন্ত করছিলাম। এখন মনে হয় আমি যদি আবার কখনো মিশরে যাই তবে শুধু এই বাহারিয়া ডেজার্ট সাফারীতেই যাবো।
ভোরবেলা রওনা হোলাম কায়রো থেকে ৩৬০ কিমি দুরত্বে ফারাফ্রা আর বাহারিয়া মরুদ্যানের মধ্যে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে অবস্হিত সাদা মরুর উদ্দেশে। পাঁচ ঘন্টা লাগবে বাসে যেতে বাহারিয়া মরুদ্যানে। আজ যাবো, মরুর বুকে রাত্রিবাস করে কাল বিকেলে ফিরে আসবো।
আড়াই ঘন্টার মত চলেছি। বাইরে প্রচন্ড গরম।শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসও বিন্দুমাত্র তাপমাত্রার কোনো হেরফের করতে পারছেনা। একবার পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছি একবার হীম শীতল ফান্টার বোতলে চুমুক কিন্ত তৃষ্ঞা মেটার কোনো লক্ষনই নেই।তারপরও ঝিমুনি কাটানোর জন্য ভীষন চা খেতে ইচ্ছে করছে। ভাবতেই হঠাৎ করে আলাদীনের চেরাগের মত সামনেই দেখি একটি ছোট্ট ফুড কোর্টের সামনে আমাদের যাত্রা বিরতি।
দুপুর বারোটার সময় বাহারিয়া মরুদ্যান শহরে পৌছালাম। মরুদ্যান হলে কি হবে ছাড়া ছাড়া কিছু খেজুর আর ঝাউ টাইপের গাছ আর তেমনি প্রচন্ড খরতাপ। এলোমেলো বাড়ীগুলো মনে হয় ধুলোয় ঢাকা মলিন চেহারা। দারিদ্রতার ছাপ সর্বত্র।

যাক এসব কথা। ট্যুরের কথায় আসি।
আমাদের সাফারী ট্যুরের আয়োজক ছিল মিশরের বিখ্যাত আহমেদ সাফারী ক্যাম্প। বাস থেকে নামতেই তাদের জীপ সাথে সাথে আমাদের পৌছে দিল তাদের বিখ্যাত আহমেদ সাফারী হোটেলে । আমরা ষোলোজন পর্যটক ছিলাম। তার মধ্যে আমেরিকান, কলম্বিয়ান, জার্মান, জাপানিজ, ইজিপশিয়ান আমেরিকান আর আমরা দুজন।
সেদিন ছিল শুক্রবার। সেখানে সবাই সুন্নি মুসলমান। আমাদের এজেন্ট, গাইড, ড্রাইভার সবাই জুমার নামাজ পড়ে আসলো।হোটেলে খেলাম রুটি পনির, কাবাব, টুনা ফিস শসার সালাদ আর কি সব চিনলাম না।মনের মত খাবার পরিবেশন করতে না পারায় তারা বেশ দু:খ প্রকাশ করতে লাগলো।
খাবার শেষে আমি হোটেলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।আধুনিক এবং ঐতিহ্য এই দুটোর সংমিশ্রনে তৈরী হোটেলটায় পাথর আর খেজুর গাছের কান্ড ব্যাবহার করা হয়েছে।মোটা পাথরে তৈরী বলে ভেতরটা তুলনামুলক ভাবে বেশ ঠান্ডা। পাথরের বেন্চ দেয়ালে খোদাই করা তাতে পাতলা কার্পেট জাতীয় দড়ি বিছানো, সেই ঠান্ডা আরামদায়ক পাথরের বেন্চে বসে রইলাম কিছুক্ষন এর মধ্যে জীপের ছাদে মাল পত্র উঠানোর কাজ চলছে। রাতের খাবার এবং সকালের নাস্তা পরিবেশন করার দায়িত্ব তাদের।
                                       
                                                       আহমেদ সাফারী ক্যাম্প হোটেল।


এজেন্ট মাহমুদ এসে জানালো আমরা প্রত্যেকে যেন কমপক্ষে দুই লিটারের দুই বোতল পানি সাথে নেই। কায়রো থেকে পাচ ঘন্টা ধরে আসতেই ছয় লিটার পানি আর দুই লিটার ফান্টা শেষ। আবারো চার লিটার পানি আর দুই লিটার ফান্টা কিনলাম। ফান্টা আমি খুব কম খাই কিন্ত টক স্বাদের জন্য ওটা আমি ওখানে খুব খেতাম, ভালোলাগতো। আমরা আরো জানতে পারলাম তারা আমাদের প্রথমে ব্ল্যাক ডেজার্ট এবং সেখান থেকে হোয়াইট ডেজার্টে নিয়ে যাবে।
আর ওখানেই রাতে থাকার জন্য ক্যাম্প করবে।
ঠিক তিনটায় চারটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারে করে তাবু, কম্বল পানি, পেট্রোল ক্যাম্প ফায়ারের জন্য কাঠ আর খাবার দাবার হাড়ি পাতিল চুলা মোট কথা যা যা দরকার সব কিছু নিয়ে রওনা দিলাম দুশ দশ কিলোমিটার দুরে সেই ভয়ংকরের উদ্দেশ্যে।
আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার আহমাদ একশ চল্লিশ কিলোমটার বেগে সেই মরুর বুক চিরে বয়ে যাওয়া সোজা রানওয়ের মত মসৃন রাস্তা দিয়ে ছুটে চল্লো গন্তব্যের উদ্দশ্যে।

                                     
                                                      ব্ল্যাক ডেজার্টে ব্ল্যাক হিল

আঠাশে সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটায় ঢাকা থেকে কুয়েত এয়ারলাইন্সের
এ ৩০০-৬০০/৬০০সি এয়ার বাস কখনোও একত্রিশ হাজার থেকে ছত্রিশ হাজার ফিট উচ্চতায় ভেসে ভেসে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কায়রোর উদ্দ্যেশ্যে। বিজনেস ক্লাসের জানালা দিয়ে চেয়ে আছি আমি নীচের দিকে।ঢাকা থেকে যখন উড়াল দিয়েছিলাম তখন ছিল মেঘের খেলা। আর চার ঘন্টা ট্রানজিট শেষে কুয়েত সিটি থেকে যখন রওনা দিলাম তখন চেয়ে দেখি ঝক ঝকে আকাশ নীচে আদিগন্ত বিস্তৃত মরুভুমি আর মাঝে মাঝে পাহাড়ের সারি।আমি অবশ্য একটু কনফিউজড ছিলাম ওগুলো কি! কিন্ত আমার ভুগোলবিশারদ স্বামী জানালো ওগুলো মরুভুমি আর পাহাড়ই।

                                      
                                                           ধু ধু সেই উষর মরুপ্রান্তর

সেই মরুর মাঝে দেখলাম চিকন ফিতার মতন একদম সোজা এক কালো রেখা মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে মিশে গেছে দিগন্ত রেখায়, কখনও বা একশ চল্লিশ বা একশ পয়তাল্লিশ ডিগ্রী বাঁক নিয়ে।আমার স্বামী জানালো ওটা রাস্তা! আমি অবাক হয়ে গেলাম এত সোজা কোনো আকাবাকা নেই!
ও বল্লো বাঁকা করার প্রয়োজন তো নেই এখানে।
এত বাহুল্য কথা বল্লাম একারনেই যে এমন একটি চকচকে সোজা মসৃন রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি সেই গন্তব্যে যা কিনা আড়াইশো কিমি তে গিয়ে শেষ হবে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জীপ, একশ চল্লিশের নীচে নামছেই না কাটা। এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার। এদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী হাসি খুশী যে বাচ্চা চালকটি তার নাম মুহাম্মাদ হামাদ।
এখানে প্রসংগত একটা কথা বলি তাহলো ওখানে যত লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের নাম হয় আহম্মেদ নয় মুহাম্মদ। শুধু এক টাংগাওয়ালার টাংগা যেটা আমি একটু চালিয়েছিলাম লুক্সরে তার নাম আবু কারিম! জীপ চলছে সেই ফিতার মতন সোজা রাস্তায়। দুপুর তিনটা বাজে প্রচন্ড গরমে দম আটকে আসছে ।এসি তে ঠান্ডা না হওয়ায় গাড়ীর জানালাটা একটু খুলে দিয়েছি। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। মুহুর্তে মুহুর্তে সবাই পানির বোতলে মুখ দিচ্ছে।ঠান্ডা পানির বোতলটা এমন গরম হয়েছে মনে হচ্ছে এখন চা পাতা দিলে চা বানানো যাবে।
                                                             

   
জীপের জানালার ফাক দিয়ে তোলা ছবি 
        আমাদের জীপে আমরা ছাড়াও দুজন ইজিপশিয়ান আমেরিকান আর দুজন খাঁটি মার্কিন মেয়ে ছিল আঠারো থেকে বিশের কোঠায় বয়স।ওরা চারজন বন্ধু। ঐ চারজনের মধ্যে একটাই ছেলে তার নাম ওমার।সে সামনের সিটে বসে অনর্গল আরবী ভাষায় কথা বলছে আহমাদের সাথে।বাকি তিনটা মেয়ে আমাদের পেছনের সীটে। মিশরে সাধারন মানুষের মধ্যে ইংরেজী ভাষার চল বেশ কম তবে ট্যুরিজমের সাথে যারা জড়িত তারা মোটামুটি কাজ চালানোর মত ইংরাজী জানে। গাইড কাম ড্রাইভার মাঝে মাঝে আমাদের সাথেও কথা বলছে সেই ঝড়ের বেগে গাড়ী চালানোর ফাকে ফাকে।
                                                                            

  
                                                              কালো মরুভুমি                                                          
ডানে বায়ে চেয়ে দেখছি হলুদ মরুভুমি কালচে হয়ে আসছে। ছোটো ছোটো টিলার মতন দেখতে অনেকটা আগ্নেয়গিরির মত লাগছে।জানলাম এটাই ব্ল্যাক ডেজার্ট। মাইলের পর মাইল এরকম দৃশ্য।
হটাৎ রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে এক বাঁক নিয়ে মরুভুমির দিয়ে চলতে শুরু করলো জীপগুলো। উচু নীচু খানা খ্ন্দক আর পাথরের টুকরোর উপর দিয়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে কোনো কার র‌্যালীর আমরা অংশগ্রহনকারী।
                                                                                

  
রাস্তা ছেড়ে কালো মরুভুমিতে প্রবেশ

কিছুদুর এভাবে চলার পর এক জায়গায় চারটি জীপই থামলো। নেমে দেখলাম
মরুভুমির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হলুদ পাথরের টিলার উপর কয়লার চেয়েও অত্যন্ত কঠিন কালো পাথরের ছোটো ছোটো টুকরোয় আবৃত চারিদিক।জানতে পারলাম সেগুলো ব্যাসল্ট আর গ্রানাইট সাথে কয়লার টুকরো ও আছে । কিন্ত পাথরগুলো আলগা হয়ে বিছিয়ে আছে।
কালো যে কত সুন্দর হতে পারে সেটাই দেখছি মনপ্রান ভরে। খুব সুন্দর সেই দৃশ্য সবাই ছবি তুলতে লাগলো। টিলা বেয়ে উঠা নামা সবই চল্লো। বাহারিয়া থেকে ৫০ কিমি দুরত্বে এই অত্যাশ্চর্য কালো মরুভুমির শুরু।
জার্মানদের মধ্যে একজন ছিল তরুন ধর্মান্তরিত মুসলমান।সে ওখানে তৈয়াম্মুম করে নামাজ আদায় করলো। এখানে অনেক গুলো ছবি তোলার কারনে আমাদের ক্যামেরার ব্যটারী কমে এসেছিল যার ফলে পরে প্রচন্ড অনুশোচনায় ভুগেছিলাম। যাক বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে সেখানে আবার রওনা দিলাম। বিকাল হয়ে আসছে খরতাপটা কমে আসছে।
                                                                            

  

সুর্য অস্তাচলে

কালো মরুভুমি শেষ হয়ে এখন এক হলুদ মরুতে প্রবেশ ঘটলো আমাদের। দু জায়গায় চেক পয়েন্ট অতিক্রম করতে হলোকর্তৃপক্ষকে বাহারিয়া থেকে পারমিশন আনতে হয় এখানে প্রবেশের জন্য । কিছুক্ষন পর রাস্তা ছেড়ে অদুরেই যেখানে গাড়ী থামলো তার নাম কৃস্টাল মাউন্টেন।
                                                                              

 

ক্রিস্টালে পরিনত হওয়া পাহাড় 

এখানে পাহাড়ের কিছু অংশ প্রচন্ড সুর্যের তাপে কৃস্টালে পরিনত হয়েছে।বেশ কস্টই হলো বেয়ে উঠতে খাড়া টিলাটায়।
এখনও অবশ্য সুর্য অস্ত যায়নি।একটা জীপের চাকার সমস্যা দেখা দেয়ায় চাকা বদলানো হলো।মিশেলিন কোম্পানির চাকা, যে কোম্পানী ফরমুলা ওয়ান রেসিং স্পন্সর করে ব্রীজস্টোনের সাথে।
আবার রওনা হোলাম এবার আমাদের গন্তব্য পিচ্চি একটা মরুদ্যান তারপর সেই স্বপ্নের তুষার মরুভুমি।

চলবে...। দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত .....



No comments:

Post a Comment

কোন এক রাতবিহারিনীকে

কোন এক রাতবিহারিনীকে (আহমেদ জী এস এর কবিতা)  হায় রে , ফুলি ! কেন পথে নেমে এলি, এ কোন সন্ধ্যাবেলা  চোখে বিষাদের হলুদ কাজল মেখে ...

জ্ঞান কি .... জ্ঞানী কে